ডায়বেটিসের কারণ, প্রকারভেদ ও উপসর্গ এবং এটি প্রতিরোধের উপায়

 

প্রায় ৪৭ কোটি মানুষ (২০-৭৯ বছর বয়স্ক) বর্তমানে ডায়বেটিসে আক্রান্ত

ডায়াবেটিস হল একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা যা সারা জীবনের জন্যে বয়ে বেড়াতে হয় এবং সারা বিশ্বে এর কারণে প্রতি বছর ১৬ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া যে কোন ব্যক্তিই এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। শরীর যখন রক্তের সব চিনিকে (গ্লুকোজ) ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ডায়াবেটিস হয়।  

এই জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হতে পারে। এছাড়াও ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিডনি এবং অনেক সময় শরীরের নিম্নাঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে। সারা বিশ্বেই এই সমস্যা বেড়ে চলেছে।

বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৭ কোটির। ৩০ বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা এখন চার গুণ বেশি। চিকিৎকরা বলছেন, ডায়াবেটিসের এতো ঝুঁকি থাকার পরেও যতো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত তাদের অর্ধেকেরও বেশি এই রোগটি সম্পর্কে সচেতন নয়। তবে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম নীতি মেনে চললে অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ডায়াবেটিস কেন হয়?

আমরা যখন কোন খাবার খাই তখন আমাদের শরীর সেই খাদ্যের শর্করাকে ভেঙে চিনিতে (গ্লুকোজ) রুপান্তরিত করে। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামের যে হরমোন নিসৃত হয়, সেটা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে নির্দেশ দেয় চিনিকে গ্রহণ করার জন্যে। এই চিনি কাজ করে শরীরের জ্বালানী বা শক্তি হিসেবে। শরীরে যখন ইনসুলিন তৈরি হতে না পারে অথবা এটা ঠিক মতো কাজ না করে তখনই ডায়াবেটিস হয়। এবং এর ফলে রক্তের মধ্যে চিনি জমা হতে শুরু করে।

কতো মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত?

ডায়বেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৭৯ জন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করে থাকেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৪২ কোটিরও বেশি। ১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম কিন্তু ২০১৪ সালের তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশকি ৫ শতাংশ। সংস্থাটি বলছে, ২০১৬ সালে ডায়াবেটিসের কারণে প্রায় ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন বলছে, প্রাপ্ত বয়স্ক যেসব মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের প্রায় ৭৯ শতাংশ মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশের, যেখানে খুব দ্রুত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে।  

ডায়াবেটিসের কারণে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?

রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। শরীরে যদি রক্ত ঠিক মতো প্রবাহিত হতে না পারে, যেসব জায়গায় রক্তের প্রয়োজন সেখানে যদি এই রক্ত পৌঁছাতে না পারে, তখন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর ফলে মানুষ দৃষ্টি শক্তি হারাতে পারে। ইনফেকশন হতে পারে পায়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির পেছনে একটি বড় কারণ ডায়াবেটিস।

কী কী ধরনের ডায়াবেটিস আছে?

ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের।

টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস: অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন রক্তের প্রবাহে গ্লুকোজ জমা হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা এখনও বের করতে পারেন নি কী কারণে এরকমটা হয়। তবে তারা বিশ্বাস করেন যে এর পেছনে জিনগত কারণ থাকতে পারে। অথবা অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও এমন হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ১০ শতাংশ এই টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত।

টাইপ টু ডায়াবেটিস: এই ধরনের ডায়াবেটিসে যারা আক্রান্ত তাদের অগ্ন্যাশয়ে যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না অথবা এই হরমোনটি ঠিক মতো কাজ করে না।সাধারণত মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধ ব্যক্তিরা টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যাদের ওজন বেশি এবং যাদেরকে বেশিরভাগ সময় বসে বসে কাজ করতে হয় তাদেরও এই ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ কিছু এলাকার লোকেরাও এই ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে। তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। সন্তানসম্ভবা হলে পরেও অনেক নারীর ডায়াবেটিস হতে পারে। তাদের দেহ থেকে যখন নিজের এবং সন্তানের জন্যে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন যথেষ্ট পরিমানে তৈরি হতে না পারে, তখনই তাদের ডায়াবেটিস হতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে ৬ থেকে ১৬ শতাংশ গর্ভবতী নারীর ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়েট, শরীর চর্চ্চা অথবা ইনসুলিন নেওয়ার মাধ্যমে তাদের শরীরে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গেলে তাদের টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

ডায়াবেটিসের অন্য কিছু বিরল কারণও আছে, এর অন্তর্ভুক্ত হল:

  • অগ্ন্যাশয় গ্রন্থির কোন সমস্যা, যেমন দীর্ঘমেয়াদী প্যান্‌ক্রিয়াটাইটিস।
  • স্টেরয়েড-এর মত ওষুধগুলির কারণে ঘটা ডায়াবেটিস।
  • সিস্টিক ফাইব্রোসিস-এর মত অন্য কোন স্বাস্থ্য সমস্যা অথবা কুশিং সিনড্রোম-এর মত একটি এন্ডোক্রিন স্বাস্থ্যসমস্যার অংশ হিসেবে হওয়া ডায়াবেটিস।
  • নিওন্যাটাল ডায়াবেটিস হল একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডায়াবেটিস যা 6 মাস বয়সের আগে হয়।
  • ল্যাটেন্ট অনসেট অটোইমিউন ডায়াবেটিস অফ অ্যাডাল্টহুড (LADA), যা টাইপ 1 ডায়াবেটিসের মতই একটি অটোইমিউন স্বাস্থ্যসমস্যা, কিন্তু এটা বেশি বয়সে দেখা দেয় এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত (কিন্তু অবিলম্বে নয়) ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়, সাধারণতঃ রোগনির্ণয়ের এক বছরের মধ্যেই, বা কখনও কখনও আরো দ্রুত তা হয়।

ডায়াবেটিসের উপসর্গগুলো কী কী ?

সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • খুব তৃষ্ণা পাওয়া স্বাভাবিকের চাইতেও ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া। বিশেষ করে রাতের বেলায়।
  • ক্লান্ত বোধ করা,
  • কোন কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া ।
  • প্রদাহজনিত রোগে বারবার আক্রান্ত হওয়া দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া।
  •  শরীরের কোথাও কেটে গেলে সেটা শুকাতে দেরি হওয়া।

 টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের লক্ষণ শৈশব থেকেই দেখা দিতে পারে এবং বয়স বাড়ার সাথে সেটা আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। বয়স ৪০ বছরের বেশি হওয়ার পর থেকে টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার লোকজনের মধ্যে এই ঝুঁকি তৈরি হয় তাদের ২৫ বছর বয়স হওয়ার পর থেকেই। যাদের পিতামাতা, ভাই বোনের ডায়াবেটিস আছে, অথবা যাদের অতিরিক্ত ওজন, দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশের মানুষ, আফ্রো-ক্যারিবিয়ান অথবা কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান তাদেরও এই ঝুঁকি বেশি থাকে।

ডায়াবেটিস কি প্রতিরোধ করা সম্ভব?

নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন। সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ।

  • প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মৃসন শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ।
  • এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
  • আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য। স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
  • এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
  • শরীর চর্চ্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রখা সম্ভব। প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।
  • ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
  • ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডা: সৈয়দ আসিফ আহমেদ

এমবিবিএস, এমআরসিপি (ইউকে) পার্ট-১

Comments

Popular posts from this blog

[ UPDATED ]How to add a Stylish Note Block [Notebox] in any Blogger Template 2022

New YouTube Tax Policy Will Reduce Income from the US Market?

Median Ui 1.6 Redesign Added Many More Feature Try It Now Fast Adsense Approval Template.